Menu |||

উত্তর কোরিয়ার এক হোটেলের রহস্যময় পাঁচতলা যার নাকি অস্তিত্বই নেই

ওটো ভার্মবিয়েরের কাহিনি মনে আছে? উত্তর কোরিয়ায় বেড়াতে যাওয়া এই আমেরিকান ছাত্রকে পিয়ংইয়ং-এর ইয়াংগাকডো হোটেলে যাবার কারণে আটক করা হয়েছিল এবং তার পরেই মৃত্যু হয়েছিল সে ছাত্রের।

মার্কিন ডাক্তার কেলভিন সান এখানে স্মৃতিচারণ করে বলেছেন সে একই হোটেলে এক গোপন অংশে তার রাত কাটানোর কাহিনি। তিনি অন্য পর্যটকদের সতর্ক করে দিচ্ছেন যে তারা যেন ওই হোটেল থেকে দূরে থাকেন।

কেলভিন সানদের সেই রাতেই উত্তর কোরিয়া ছেড়ে যাবার কথা ছিল। তিনি ২৪ ঘন্টার বেশি সময় ধরে নির্ঘুম ছিলেন। তিনি এবং তার বন্ধুরা একটা মিনিবাসে উঠলেন পিয়ংইয়ং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে যাবার জন্য।

এমন সময় মিনিবাসটিতে উঠলো উত্তর কোরিয়ান রক্ষীদের একটি দল।

কর্মকর্তারা বললেন, একটা সমস্যা হয়েছে। সেটার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কেলভিন সানদের গ্রুপটিকে যেতে দেয়া হবে না।

বাসের মধ্যে একটা নিরবতা নেমে এলো।

সান ভাবছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন দেশে তার গত একটি সপ্তাহ ঘুরে বেড়ানোর কথা। এটি ছিল তার সবচেয়ে স্মরণীয় ভ্রমণগুলোর একটি।

“উত্তর কোরিয়ায় ওই এক সপ্তাহে আমরা এত কিছু করেছিলাম যে আমাদের মনেই হয়নি সে হোটেলের পাঁচ তলায় যাওয়াটা কোন সমস্যার কারণ হতে পারে,” বলছিলেন সান।

রক্ষীরা বললো, পর্যটকদের দলটিকে মিনিবাস থেকে নেমে আসতে। তখনও তার ওই ব্যাপারটার কথা মনে হয়নি।

কেলভিন সানের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা নিউইয়র্ক শহরে। তার বাবা-মা চীনা।

তার বয়স কুড়ির কোঠায় পৌঁছানোর আগে তিনি ওই রাজ্য ছেড়ে বলতে গেলে বের হননি।

তিনি তখন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েটের ছাত্র, যার ক্যাম্পাস নিউইয়র্কের বাড়ি থেকে মাত্র ২০ মিনিটের পথ। তাকে তার পরিচিত গন্ডির বাইরে বের হতে হয়নি।

কিন্তু ২০১০ সালে তিনি মিশরে বেড়াতে গেলেন, আর সেই থেকেই তার পৃথিবী ঘুরে দেখার আকাঙ্খা জেগে উঠলো। তিনি ‘মনসুন ডায়রিজ’ নামে ভ্রমণ সংক্রান্ত একটি ব্লগ লেখা শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তার বহু ‘ফলোয়ার’ জুটে গেল।

প্রতি ছুটি এবং শনি-রবিবারগুলোকেও তিনি কোন না কোন নতুন দেশে যাবার জন্য ব্যবহার করতে লাগলেন। তার লক্ষ্য ছিল, কোন অভিজ্ঞতার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, এবং এক দেশে তাকে দ্বিতীয়বার যেতে না হয় – তা নিশ্চিত করা।

মেডিক্যাল স্কুলে তার দ্বিতীয় বর্ষ শুরুর আগেই সান ঠিক করলেন, গ্রীষ্মের ছুটিকে তিনি এমন একটা ভ্রমণে বের হবেন যা শুরু হবে মধ্যপ্রাচ্যের কোন একটি দেশ থেকে এবং শেষ হবে এশিয়ার কোন এক জায়গায়।

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

ইয়াংগাকডো হোটেল

তিনি যে ভ্রমণসূচি তৈরি করলেন, তা ছিল খুবই ঢিলেঢালা। এমন কিছু ফাঁকা দিন রাখা হলো – যে সময়গুলোয় তিনি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বন্ধুদের সাথে আশপাশের কোথাও চলে যেতে পারবেন।

উত্তর কোরিয়াও তার মূল পরিকল্পনার অংশ ছিল না। পিয়ংইয়ং-এর ইয়াংগাকডো হোটেলের গোপন পাঁচতলা তো ঘুণাক্ষরেও ছিল না।

সেটা ছিল ২০১১ সাল। তখনকার দিনে পশ্চিমা পর্যটকরা উত্তর কোরিয়া যেতে চাইলে একজন প্রাইভেট ট্যুর অপারেটরের সাহায্য নিতে হতো।

সে সময় পাঁচ-ছ’টি আন্তর্জাতিক ট্যুর অপারেটর ছিল যারা চীন হয়ে উত্তর কোরিয়ায় গাইডেড ট্যুর করাতো।

কিন্তু ২০১৭ সালে এই ধরণের ভ্রমণের নিয়মকানুন কঠোর করা হয়। অনেকের মতে এর একটা কারণ ছিল, একজন পশ্চিমা ছাত্র এভাবে উত্তর কোরিয়ায় গিয়ে ইয়াংগাকো হোটেলের সেই নিষিদ্ধ পঞ্চম তলায় গিয়েছিলেন।

বেইজিং থাকার সময় কেলভিন সান দেখলেন, আমেরিকায় ফিরে যাবার আগে তার হাতে এক সপ্তাহ সময় আছে।

তিনি ভাবলেন, উত্তর কোরিয়ায় যাবার জন্য এটাই তো সুবর্ণ সুযোগ।

তিনি তখন ট্যুর অপারেটরদের সাথে যোগাযোগ করলেন এবং যে সবচেয়ে ভালো অফার দিলো তাকে বেছে নিলেন।

“আমি যত ভিসা ফর্ম পূরণ করেছি তার মধ্যে অন্যতম সহজ ছিল উত্তর কোরিয়ারটি। সেদেশে যাবার আবেদনের জন্য আপনাকে এমনকি পাসপোর্টটিও জমা দিতে হতো না। আমার ধারণা অনেক লোকই চেষ্টা করতেও চায় না কারণ তারা মনে করে ব্যাপারটা খুব ঝামেলার হবে।”

নিউইয়র্কে ফিরে যাবার আগে সে দফায় উত্তর কোরিয়াই ছিল শেষ দেশ। এর পরই তার মেডিক্যাল স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষের পড়াশোনায় ফিরে যাবার কথা।

সান ছিলেন ২০ জনের একটি গ্রুপের অংশ। এতে আমেরিকান, ইউরোপিয়ান এবং চীনা পর্যটকরা ছিলেন – যাদের অধিকাংশের বয়েসই ছিল ২০-এর কোঠায়।

বেইজিংএ তারা ট্যুর আয়োজকদের সাথে দেখা করলেন, তাদের বুঝিয়ে দেয়া হলো যে উত্তর কোরিয়া সফরের সময় কিভাবে চলতে হবে।

বলা হলো, উত্তর কোরিয়ার সংস্কৃতিকে সম্মান করতে হবে, সব সময় গাইডদের কথা শুনতে হবে।

রাজধানী পিয়ংইয়ংএ তারা থাকবেন ইয়াংগাকডো হোটেলে। তবে এর পাঁচতলার ব্যাপারে কোন কিছুই বলা হয় নি।

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

কেলভিন সান পিয়ং ইয়ং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

পিয়ংইয়ং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই সানের চোখে পড়লো যে জায়গাটা চীনের চেয়ে কত আলাদা।

“মনে হলো যেন ঈশ্বর নিজেই সব রঙকে অনুজ্জ্বল করে দিয়েছেন,”বলছিলেন সান

“বেইজিং ছিল এক রঙিন শহর। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার সাথে তুলনায় তাকে রীতিমত উৎকট মনে হবে।”

“শহরের ভবন, পোস্টার, রাস্তার নির্দেশিকা, লোকজনের কাপড়-চোপড় – সবই যেন শুধু সাদা, ধূসর বা কালো। তার মাঝে একটু হয়তো লাল আছে – কারণ তা কমিউনিস্ট পার্টির রঙ। মনে হচ্ছিল যেন আমি একটা টাইম মেশিনে বসে ১৯৭০এর দশকের সোভিয়েট টিভির অনুষ্ঠানে ঢুকে পড়েছি।”

সান এবং তার দলকে উত্তর কোরিয়া ঘুরে দেখানোর দায়িত্বে ছিলেন দুজন পুরুষ এবং একজন মহিলা গাইড। তাদের বয়েস ছিল ৪০-এর কোঠায়।

তারা জানালেন, দু’জনই এক সময় উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনীতে কর্মকর্তা ছিলেন।

“শুরুতে তাদের মনে হয়েছিল একটু কড়া ধরণের। তারা বলছিল, তাদের সাহায্য ছাড়া রাস্তার পার না হতে, বা কিছু-কিছু ভবনের ছবি না তুলতে। কিন্তু একটু পরই আমাদের সাথে তাদের বেশ ভাব হয়ে গেল।”

সান বলছিলেন,”গাইডরা মদ্যপান করতে ভালোবাসতেন। আমরা জানতে পারলাম যে কোরিয়ান সংস্কৃতিতে মদের একটা কেন্দ্রীয় ভুমিকা আছে, এবং তারা প্রতি সন্ধ্যাতেই তাদের সাথে আড্ডা-গল্পগুজব করতে আমাদেরকে উৎসাহিত করতেন।”

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

পিয়ংইয়ং

তারা উত্তর কোরিয়ার বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গা ঘুরলেন। যেমন জুচে টাওয়ার, ওয়াকার্স মেমোরিয়াল, দুই কোরিয়ার মধ্যেকার অসামরিকীকৃত অঞ্চল। আরো দেখলেন ইউএসএস পুয়েবলো – ১৯৬৮ সালে উত্তর কোরিয়ার জিম্মি করা মার্কিন নৌ-বাহিনীর জাহাজ।

তবে উত্তর কোরিয়া কী চোখে আমেরিকাকে দেখে সেটির আসল ধারণা সান পেয়েছিলেন সেই সব মদ্যপান এবং সামাজিক মেলামেশার সময়।

দেশটিতে ইন্টারনেট সরকার-নিয়ন্ত্রিত এবং সেখানকার টিভিও সীমিত এবং প্রধানত: সরকারি প্রচারণাই চালানো হয়।

“আমাদের গাইডরা মাইকেল জ্যাকসনের ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিল। তারা আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছিল, তিনি এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন কিনা। তারা যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের নির্মমতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন করেছিল। উত্তর কোরিয়ায় যে অল্প কিছু আন্তর্জাতিক টিভি অনুষ্ঠান দেখানো হতো তার একটি ছিল আমেরিকান রিয়ালিটি শো ‘কপস’ যাতে পুলিশ কর্মকর্তাদের অনুসরণ করে তার বাস্তব অভিযান দেখানো হয়। এটি নিয়েও তারা অনেক প্রশ্ন করতো।”

কিন্তু তাদের প্রশ্নের বিষয়বস্তু নয় – বরং যেভাবে তারা প্রশ্নগুলো করতো, সেটাই সানকে চমৎকৃত করতো।

“মনে হতো এটা নিতান্ত কৌতুহলের চাইতেও বেশি কিছু। যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের মনে যে বিশেষ ধারণা রয়েছে – সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছেন তারা।”

উত্তর কোরিয়ার একটি গ্রামে এক শুটিং রেঞ্জে সান তার জীবনের প্রথমবারের মতো বন্দুকের গুলি ছুঁড়লেন। গ্রুপের বেশির ভাগের গুলিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। “গাইডদের মনে আমেরিকার বন্দুক-সহিংসতা সম্পর্কে যে ধারণা ছিল – তাতে তারা আমাদের হাতের টিপ এত খারাপ দেখে উচ্চস্বরে তাদের বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।”

কয়েকদিন পার হবার পর নিয়মকানুন নিয়ে গাইডদের কড়াকড়ি কমে গেল।

এর পর গ্রুপের কেউ একা-একা রাস্তা পার হলে তারা আর উদ্বিগ্ন হতেন না। ছবি না তোলার জন্য নির্দেশও আর দিতেন না তারা।

সপ্তাহটি ছিল সত্যি মনে রাখার মতো। সানের সাথে খুব দ্রুতই অন্য সফরসঙ্গীদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল।

গাইডদের সাথেও সম্পর্ক সহজ হয়ে এলো তাদের। উত্তর কোরিয়ায় তাদের শেষ রাতে পুরো গ্রুপটি সবাই মিলে ডিপ্লো নামে একটা নাইটক্লাবে গেলেন।

সেখানে মাইকেল জ্যাকসন সহ ১৯৮০-র দশকের বিভিন্ন গানের সাথে তারা নাচলেন।

ইয়াংগাকডো হোটেলে ফিরে গাইডরা আরো একদফা মদ্যপানের জন্য গ্রুপটিকে আমন্ত্রণ জানালেন। তারা বেশি সময় ছিলেন না। তারা একটা ব্যস্ত সপ্তাহ কাটিয়েছেন।

এর পর গ্রুপটির সদস্যরা যে যার রুমের দিকে রওনা দিলেন। কিন্তু কয়েকজন, যারা অতটা ক্লান্ত হননি, তারা ভাবলেন ঘুমোতে যাবার আগে একটা ঘরে সবাই মিলে আবার একটা আড্ডা হোক।

তখনই আরেকজন প্রস্তাব করলেন, হোটেলটার বাকি অংশগুলো ঘুরে দেখলে কেমন হয়?

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

কেলভিন সান হোটেলের পাঁচতলার সন্ধানে কেলভিন সানদের অভিযান

উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে উঁচু ভবনগুলোর একটি হচ্ছে ৪৭-তলা এই ইয়াংগাকডো হোটেল। তায়েডং নদীর মাঝখানে একটি দ্বীপের ওপর গড়ে তোলা হয়েছে এই হোটেল।

এতে আছে চারটি রেস্তোরাঁ, বোলিং এবং ম্যাসাজ পার্লার। বেডরুমগুলোতে টিভি আছে তাতে পুরোনো বিবিসির ওয়ার্ল্ড নিউজ বার বার দেখানো হয়।

এ দেশে আসা টুরিস্টদের কাছে এটাই সবচেয়ে পছন্দের থাকার জায়গা।

উত্তর কোরিয়ার টুরিস্ট বোর্ড একে পাঁচতারা হোটেল হিসেবে প্রচার করে কিন্তু ইন্টারনেটে পর্যটকদের মূল্যায়নে একে তিন-তারার কাছাকাছি বলে উল্লেখ করা হয়।

“দেখে মনে হতে পারে যেন তারা ১৯৮৪ সালে ভেগাসে কাউকে পাঠিয়েছিল, বলা হয়েছিল, ওখানে গিয়ে দেখে এসো কী কী আছে, তার পর হুবহু সেরকম একটা হোটেল বানিয়ে ফেলো। তারা সেটাই করেছে, কিন্তু তা করতে গিয়ে গোলমাল করে ফেলেছে,” এমন বর্ণনাই করেছেন একজন ব্লগার।

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

কেলভিন সান কেলভিন সান বলেন, তারা যা করছিলেন তা কত গুরুতর তা বোঝেন নি তারা

এই হোটেলে পাঁচ রাত থাকার সময় সান এবং তার সফরসঙ্গীদের সাথে সর্বক্ষণ ছিল গাইডরা।

তাদের ছাড়া নিজেরা নিজেরা ভবনটি ঘুরে দেখার এটাই সুযোগ। তাছাড়া এমন কোন নিয়মের কথা তো বলা হয়নি যে হোটেলটা ঘুরে দেখা যাবে না।

তারা প্রথমে উঠলেন খোলা ছাদে। তারপর গেলেন একেবারে ওপরের তলায় ঘুর্ণায়মান রেস্তোরাঁতে। তার পর লিফট দিয়ে নিচে নামতে লাগলেন।

তখনই গ্রুপের একজন খেয়াল করলেন যে লিফটে পাঁচ তলায় যাবার কোন বোতাম নেই। লিফটের প্যানেলে দেখা যাচ্ছে চারতলা, তার পরই পাঁচ বাদ দিয়ে ছয় তলা।

“আমাদের দেখা উচিত এর কোন পাঁচ তলা আসলেই আছে কিনা। নাকি তারা কোন কুসংস্কারের কারণে ইচ্ছা করেই লিফটে পাঁচতলা বলে কিছু রাখেনি,”একজন বললেন।

ভ্রমণ বিষয়ক ব্লগাররা এই হোটেলের গোপন পাঁচতলায় কি আছে তা নিয়ে ইন্টারনেটে অনেক জল্পনা কল্পনা করেছেন।

সানের গ্রুপে কয়েকজন ছিলেন যারা অভিজ্ঞ পর্যটক, তারা এটার কথা শুনেছিলেন। সান এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।

“ইয়াংগাকডো হোটেলের পাঁচ তলায় গেছি এমন প্রথম লোক আমরা ছিলাম না, শেষও ছিলাম না। ২০১১ সাল পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ায় কোন পর্যটককে কখনো আটক করা হয় নি। আমরা যা করছিলাম তা কতটা গুরুতর তার কোন ধারণা আমাদের ছিল না।”

সানরা যে ট্যুর অপারেটরকে ভাড়া করেছিলেন, সেই ইয়ং পাইওনিয়ার ট্যুরসের ওয়েবসাইটে এখন একটি পাতা আছে যাতে বলা আছে যে পর্যটকদের জন্য পাঁচ তলায় যাওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

এরকম কোন সতর্কবাণী ২০১১ সালে অনলাইনে বা অফলাইনে কোথাও ছিল না।

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

কেলভিন সান রহস্যময় পাঁচতলায় কেলভিন সানের দল

“আমাদের কখনোই পঞ্চম তলা থেকে দূরে থাকতে বলেনি আমাদের গাইডরা। এ নিয়ে কোন কথাই হয়নি।”

অন্য একজন পর্যটক যিনি এর আগেও সেখানে গেছেন, তিনি জানিয়েছিলেন যে পঞ্চম তলার যেহেতু টেকনিক্যালি কোনো অস্তিত্ব নেই, তাই সেখানে গেলে তাদের কোনো অসুবিধে হবেনা।

ফলে সান-রা চারতলায় পৌঁছে লিফট থেকে বেরিয়ে এলন, এবং হোটেলের পেছনের অংশের সিঁড়ির দিকে গেলেন। তারা হাসিখুশিই ছিলেন, তবে সান বলেন যে তাদের ভেতরে একটা উত্তেজনাও কাজ করছিল।

“আমাদের একজন করিডোরে আমাদের আগে আগে হাঁটছিল। সে হঠাৎ ঘুরে দৌড়ে এলো। বললো, ‘না, এদিকে নয়, আমি একটা চিৎকার শুনতে পেয়েছি।’

সান বলেন, তিনি কোন চিৎকার শুনতে পাননি, কিন্তু তার ভয়-ভয় লাগছিল।

“আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে দিক পরিবর্তন করে আমরা ছয় তলায় যাবো, তার পর সিঁড়ি দিয়ে পাঁচ তলায় নামবো।”

এই পথ দিয়ে পাঁচ তলায় ঢুকতে গিয়ে তারা দেখলেন সেখানে কোন পাহারা নেই, এবং পথটা খোলা। তারা যার যার ক্যামেরা বের করলেন, এবং ভেতরে ঢুকলেন।

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

কেলভিন সান ঘরগুলোর ছাদ খুব নিচু

প্রথম যেটা তাদের চোখে পড়লো যে সেই ফ্লোরের ছাদ খুব নিচু, অন্য তলাগুলোর তুলনায় প্রায় অর্ধেক। তাদের কয়েকজনকে মাথা কাত করে বা নিচু করে চলতে হচ্ছিল। তারা একেকজন গেলেন একেক দিকে।

হাঁটতে হাঁটতে সান লক্ষ্য করলেন যে পুরো জায়গাটায় আলো খুব কম, কংক্রিটের বাংকারের মতো। নিচু সিলিং ছাড়া বাকিটা দেখতে একটা সাধারণ হোটেলের করিডোরের মতোই, দুপাশে দরজা।

বেশিরভাগ দরজাই বন্ধ, তবে একটি কক্ষ খোলা। দরজার বাইরে একজোড়া জুতো পড়ে আছে। কিন্তু ভেতরে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলেন না তারা।

“ঘরটার ভেতর থেকে আলো আসছিল। আমরা সিকিউরিটি ক্যামেরা দেখতে পেলাম। কিছু টিভি পর্দা আছে, তাতে বিভিন্ন বেডরুমের ভেতরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, এমন কিছু যন্ত্রপাতি দেখা যাচ্ছে যা নজরদারির জন্য ব্যবহৃত হয় বলে মনে হলো। আমি ভাবলাম, হোটেলের কর্মীরা অতিথিদের ওপর নজরদারি করার যে কথা শোনা গেছে তার যন্ত্রপাতি এখানেই রাখা হয়।”

সানের একজন বন্ধু জায়গাটির একটা ভিডিও করতে শুরু করলেন ।সান ছবি তুলতে লাগলেন। সবাই কথা বলছিলেন ফিস ফিস করে।

আমরা দুর্ঘটনাবশত: ফ্ল্যাশ ফটোগ্রাফিও ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু আমাদের খুঁজে বের করতে কেউ আসেনি।

ঘরগুলোর দেয়ালে উজ্জ্বল রঙে আঁকা আমেরিকা ও জাপান-বিরোধী প্রচারণামূলক ছবি ঝোলানো ছিল। এর কোনো কোনোটিতে ছিল সাবেক শীর্ষ নেতা কিম জং ইলের ছবি।

একটি ছবির ক্যাপশনে বলা হয়েছে: “এই বোমা আমেরিকানদের তৈরি। আমেরিকানদের তৈরি যে কোন জিনিসই আমাদের শত্রু। আমেরিকার বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ বার প্রতিশোধ নাও।”

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

কেলভিন সান আমেরিকান সবকিছুই আমাদের শত্রু’

কয়েক মিনিট পরে একজন অপরিচিত লোক ছায়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এগিয়ে এলো তাদের দিকে।

“পথ হারিয়েছো?” সে শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো ইংরেজিতে।

কেউ একজন বললো, হ্যাঁ। লোকটি মাথা নাড়লো, আঙুল দেখালো সিঁড়ির দিকে।

“সে আমাদের সাথে আমাদের রুম পর্যন্ত আসেনি, তাকে ক্রুদ্ধ বা উত্তেজিতও মনে হয় নি।”

গ্রুপটি একটি বেডরুমে ফিরে এলেন, তারা একমত হলের যে ওই হোটেলে কর্মকর্তার সাথে দেখা হওয়াতে তারা হুমকি অনুভব করেননি। কয়েকজন বললো তারা আবার যাবে সেখানে।

পাঁচতলায় গিয়ে ওই গ্রুপের একজন একটা দরজা খুললো। কিন্তু খোলার পর দেখা গেল একটা ইটের দেয়াল ছাড়া কিছুই নেই। আরেকজন আরেকটি দরজা খুলে দেখতে পেলো, সেখান থেকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে আরেক তলায়।

“বলতে পারেন, একটা ফ্লোরের ভেতরই আরেকটা ফ্লোর।”

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

কেলভিন সান জাপানবিরোধী পোস্টার

তারা আরো তালাবন্ধ কক্ষ এবং দেয়ালে লাগানো আরো পোস্টার দেখতে পেলেন। সানের কোরিয়ান ভাষা জানা ছিল না। কিন্তু ইউটিউবে তার ভিডিও তোলার পর তিনি এর কিছু বার্তার অর্থ জানতে পারলেন।

এসব পোস্টারে কিম পরিবারের শক্তি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রতিশোধ নেবার কথা আছে।

একবিংশ শতাব্দীকে প্রযুক্তির যুগ বলে ঘোষণা করা হয়েছে আরেকটি পোস্টারে, তাতে দেখা যাচ্ছে ১৯৮০র দশকের একটি কম্পিউটারের ছবি।

একটু পর আরেক জন হোটেল কর্মকর্তা সেখানে আবির্ভূত হলেন, এবং ভদ্রভাবে বললেন তাদের যার যার ঘরে ফিরে যেতে।

কিন্তু এরপরও কয়েকজন তৃতীয় বারের মতো ওই পাঁচতলায় গেলেন। এর মধ্যে দু’জন আলাদা হয়ে একটু আড়ালে গিয়ে চুমু খেলেন (এই তথ্য বের হয়েছিল অনেক বছর পর এক পুনর্মিলনীতে)।

এবার আরেকজন রক্ষী সেখানে এলেন, এবং আবারও শান্তভাবে তাদের ঘরে ফিরে যেতে বললেন।

“আমাদের সবারই বয়েস ছিল ২০-এর কোঠায়। আমার বোকা এবং সরল ছিলাম। আমাদের কাছে ব্যাপারটা নির্দোষ এবং উত্তেজনাপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তার পরের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, আমরা এখন যা জানি তা তখন জানলে এটা করতাম না।”

সান এবং তার সঙ্গীরা ভোর পাঁচটার দিকে যার যার ঘরে গেলেন। জিনিসপত্র ব্যাগে ভরে ফ্লাইটের জন্য তৈরি হলেন। তাদের মিনিবাস আসার কথা ঠিক দু’ঘন্টা পরই।

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

কলভিন সান পোস্টার: আমাদের জেনারেলই সবার সেরা

কিন্তু সকাল সাতটায় মিনিবাসে ওঠার পরই যখন হোটেল কর্মকর্তারা এসে তাদের বাস থেকে নামতে বললেন, তখন পুরো গ্রুপটির মধ্যেই উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়লো।

গাইডরা বললো, তারা জানে যে গ্রুপের একজন সদস্য কি করেছে, এবং এখনই তাদের তা স্বীকার করতে হবে। গ্রুপের কেউ কোন কথা বললো না।

একজন কর্মকর্তা বললো. ইয়াংগাকডো হোটেলের প্রাইভেট কক্ষ থেকে এমব্রয়ডারি করা তোয়ালে কেউ অনুমতি ছাড়া নিয়ে গেছে। গ্রুপটি যদি বাড়ি ফিরতে চায় তাহলে তোয়ালেগুলো ফেরত দিতে হবে।

কেউ দোষ স্বীকার করলো না।

টুর গাইডরা কর্মকর্তাদের সাথে একটা চুক্তি করলো। তারা যদি পেছন ফিরে বাস থেকে নেমে যায়, তাহলে অপরাধী তোয়ালেগুলো মাটির ওপর রেখে দেবে। এটাই হবে সমস্যা সমাধানের সবচাইতে দ্রুত পদ্ধতি।

রক্ষীরা মেনে নিলো।

চুরি করা তোয়ালে ফেরত পাওয়া গেল, কিন্তু চোর চিহ্নিত হলো না।

গ্রুপটি এরপর এয়ারপোর্টে গেল। উত্তর কোরিয়ান ভিসা ফেরত দিল। তাদের পাসপোর্টে সিল ছাড়াই তারা উত্তর কোরিয়া ত্যাগ করলো।

সান এর পরের বছর মেডিক্যাল স্কুলে তার দ্বিতীয় বছরের পড়াশোনা শুরু করলেন। পাঁচ তলার কথা তার প্রায় মনেই ছিল না।

কিন্তু চার বছর পরের এক ঘটনা সব বদলে দিলো।

—————

দু হাজার পনেরো সালে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ওটো ভার্মবিয়ের উত্তর কোরিয়া বেড়াতে যান কেলভিন সানের মত ঠিক একই কর্মসূচি নিয়ে। তার টুর অপারেটরও ছিল সেই একই ইয়ং পাইয়োনিয়র টুরস, তিনি ছিলেনও সেই একই ইয়াংগাকডো হোটেলে।

উত্তর কোরিয়ান কর্মকর্তারা বলেন, ভার্মবিয়ের ওই হোটেল থেকে একটি উত্তর কোরিয়ান পোস্টার চুরি করার চেষ্টা করেছিলেন।

এর পর তার একটা সাজানো বিচার হয়, টিভিতে প্রচার হয় একটা জোর করে ধারণ করা স্বীকারোক্তি।

বন্দী অবস্থায় তিনি আহত হন, এবং সংজ্ঞা হারান। আর কখনো তার জ্ঞান ফেরে নি।

২০১৭ সালের জুন মাসে ওটো ভার্মবিয়েরের মৃত্যু আন্তর্জাতিক সংবাদের শিরোনাম হয়।

সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজে আভাস পাওয়া যায় যে ভার্মবিয়ের ওই হোটেলের এমন একটি অংশে গিয়েছিলেন – যা সাধারণ লোকের জন্য উন্মুক্ত নয়।

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

ওটো ভার্মবিয়ের, আটক হবার পর

ওই হোটেলে আগে গেছেন এমন কয়েকজন বলেছেন, তিনি নিশ্চয়ই সেই পাঁচ তলায় গিয়েছিলেন এবং দেয়াল থেকে কোন একটি প্রচারণামূলক পোস্টার সরিয়েছিলেন।

কিন্তু উত্তর কোরিয়ার সরকার বা হোটেলে কর্তৃপক্ষ কখনোই তা নিশ্চিত করেনি, যেভাবে তারা কখনো পঞ্চম তলার অস্তিত্বের কথাও স্বীকার করে নি।

সান বলছেন, “আমরা যখন সেখানে ছিলাম তখন সেখোনে এমন কোন পোস্টার ছিল না যা খুলে নেয়া যাবে। সবই ছিল দেয়ালে আঁকা বা দেয়ালের সাথে পেরেক দিয়ে আটকানো। এমন নয় যে আমরা কিছু নেবার কথা ভেবেছি, কিন্তু সেখানে এমন কিছুই ছিল না যা আমাদের পক্ষে চুরি করা সম্ভব ছিল, ঘরের বাইরের জুতো দুটি ছাড়া।”

ভার্মবিয়েরের মৃত্যুর পর উত্তর কোরিয়ায় পর্যটনের দিকে সবার নজর পড়ে।

ইয়ং পাইওনিয়র ট্যুরস সহ বেশ কিছু ট্যুর অপারেটর মার্কিন নাগরিকদের উত্তর কোরিয়ায় নিয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। তাদের ওয়েবসাইটে বলা হয়, ওই হোটেলের পাঁচতলাটি একটি সার্ভিস ফ্লোর যাতে কারো প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

সান এখন একজন ডাক্তার। তিনি সুযোগ পেলেই এখনো ভ্রমণ করেন। তার ব্লগে হাজার হাজার ফলোয়ার রয়েছে। তবে এখন তিনি অন্য দেশে বেড়াতে গিয়ে কি করছেন সে সম্পর্কে অনেক বেশি সতর্ক।

“ওটোর যা হয়েছে, তা আমার কাছে একটা মর্মান্তিক ব্যাপার। এখন আমরা যতটুকু জানি, তার ভিত্তিতে আমি সব পর্যটককে বলবো তা যখন যে দেশে যায় সেই দেশের রীতিনীতিকে যেন সম্মান করে।”

“তবে ২০১১ সালে আমাদের জানা ছিল না যে আমরা কোন বাড়াবাড়ি করছি কিনা বা আমরা যা করছি তাতে ওটোর মতো দু:খজনক পরিণতিও হতে পারতো।”

(অন্য কোন কিছু উল্লেখ না করা থাকলে এই প্রতিবেদনের সব ছবির স্বত্বই কেলভিন সান এবং দি মনসুন ডায়রিজের।)

 

সূত্র, বিবিসি

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» তারেক মনোয়ার একজন স্পষ্ট মিথ্যাবাদী

» কুয়েতে নতুন আইনে অবৈধ প্রবাসীদের কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে

» সোশ্যাল প্লাটফর্মে লন্ডনী মেয়েদের বেলেল্লাপনা,চাম্পাবাত সবার শীর্ষে

» ফারুকীর পদত্যাগের বিষয়টি সঠিক নয়

» পাকিস্তান থেকে সেই আলোচিত জাহাজে যা যা এল

» মিছিল করায় আট মাস ধরে সৌদি কারাগারে ৯৩ প্রবাসী, দুশ্চিন্তায় পরিবার

» কুয়েতে যুবলীগের ৫২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

» ক্ষমা না চাইলে নুরের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়

» বাকু থেকে ফিরলেন ড. মুহাম্মাদ ইউনূস

» শুক্রবার আহত ও শহীদদের স্মরণে কর্মসূচি দিলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

Agrodristi Media Group

Advertising,Publishing & Distribution Co.

Editor in chief & Agrodristi Media Group’s Director. AH Jubed
Legal adviser. Advocate Musharrof Hussain Setu (Supreme Court,Dhaka)
Editor in chief Health Affairs Dr. Farhana Mobin (Square Hospital, Dhaka)
Social Welfare Editor: Rukshana Islam (Runa)

Head Office

UN Commercial Complex. 1st Floor
Office No.13, Hawally. KUWAIT
Phone. 00965 65535272
Email. agrodristi@gmail.com / agrodristitv@gmail.com

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
,

উত্তর কোরিয়ার এক হোটেলের রহস্যময় পাঁচতলা যার নাকি অস্তিত্বই নেই

ওটো ভার্মবিয়েরের কাহিনি মনে আছে? উত্তর কোরিয়ায় বেড়াতে যাওয়া এই আমেরিকান ছাত্রকে পিয়ংইয়ং-এর ইয়াংগাকডো হোটেলে যাবার কারণে আটক করা হয়েছিল এবং তার পরেই মৃত্যু হয়েছিল সে ছাত্রের।

মার্কিন ডাক্তার কেলভিন সান এখানে স্মৃতিচারণ করে বলেছেন সে একই হোটেলে এক গোপন অংশে তার রাত কাটানোর কাহিনি। তিনি অন্য পর্যটকদের সতর্ক করে দিচ্ছেন যে তারা যেন ওই হোটেল থেকে দূরে থাকেন।

কেলভিন সানদের সেই রাতেই উত্তর কোরিয়া ছেড়ে যাবার কথা ছিল। তিনি ২৪ ঘন্টার বেশি সময় ধরে নির্ঘুম ছিলেন। তিনি এবং তার বন্ধুরা একটা মিনিবাসে উঠলেন পিয়ংইয়ং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে যাবার জন্য।

এমন সময় মিনিবাসটিতে উঠলো উত্তর কোরিয়ান রক্ষীদের একটি দল।

কর্মকর্তারা বললেন, একটা সমস্যা হয়েছে। সেটার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কেলভিন সানদের গ্রুপটিকে যেতে দেয়া হবে না।

বাসের মধ্যে একটা নিরবতা নেমে এলো।

সান ভাবছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন দেশে তার গত একটি সপ্তাহ ঘুরে বেড়ানোর কথা। এটি ছিল তার সবচেয়ে স্মরণীয় ভ্রমণগুলোর একটি।

“উত্তর কোরিয়ায় ওই এক সপ্তাহে আমরা এত কিছু করেছিলাম যে আমাদের মনেই হয়নি সে হোটেলের পাঁচ তলায় যাওয়াটা কোন সমস্যার কারণ হতে পারে,” বলছিলেন সান।

রক্ষীরা বললো, পর্যটকদের দলটিকে মিনিবাস থেকে নেমে আসতে। তখনও তার ওই ব্যাপারটার কথা মনে হয়নি।

কেলভিন সানের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা নিউইয়র্ক শহরে। তার বাবা-মা চীনা।

তার বয়স কুড়ির কোঠায় পৌঁছানোর আগে তিনি ওই রাজ্য ছেড়ে বলতে গেলে বের হননি।

তিনি তখন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েটের ছাত্র, যার ক্যাম্পাস নিউইয়র্কের বাড়ি থেকে মাত্র ২০ মিনিটের পথ। তাকে তার পরিচিত গন্ডির বাইরে বের হতে হয়নি।

কিন্তু ২০১০ সালে তিনি মিশরে বেড়াতে গেলেন, আর সেই থেকেই তার পৃথিবী ঘুরে দেখার আকাঙ্খা জেগে উঠলো। তিনি ‘মনসুন ডায়রিজ’ নামে ভ্রমণ সংক্রান্ত একটি ব্লগ লেখা শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তার বহু ‘ফলোয়ার’ জুটে গেল।

প্রতি ছুটি এবং শনি-রবিবারগুলোকেও তিনি কোন না কোন নতুন দেশে যাবার জন্য ব্যবহার করতে লাগলেন। তার লক্ষ্য ছিল, কোন অভিজ্ঞতার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, এবং এক দেশে তাকে দ্বিতীয়বার যেতে না হয় – তা নিশ্চিত করা।

মেডিক্যাল স্কুলে তার দ্বিতীয় বর্ষ শুরুর আগেই সান ঠিক করলেন, গ্রীষ্মের ছুটিকে তিনি এমন একটা ভ্রমণে বের হবেন যা শুরু হবে মধ্যপ্রাচ্যের কোন একটি দেশ থেকে এবং শেষ হবে এশিয়ার কোন এক জায়গায়।

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

ইয়াংগাকডো হোটেল

তিনি যে ভ্রমণসূচি তৈরি করলেন, তা ছিল খুবই ঢিলেঢালা। এমন কিছু ফাঁকা দিন রাখা হলো – যে সময়গুলোয় তিনি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বন্ধুদের সাথে আশপাশের কোথাও চলে যেতে পারবেন।

উত্তর কোরিয়াও তার মূল পরিকল্পনার অংশ ছিল না। পিয়ংইয়ং-এর ইয়াংগাকডো হোটেলের গোপন পাঁচতলা তো ঘুণাক্ষরেও ছিল না।

সেটা ছিল ২০১১ সাল। তখনকার দিনে পশ্চিমা পর্যটকরা উত্তর কোরিয়া যেতে চাইলে একজন প্রাইভেট ট্যুর অপারেটরের সাহায্য নিতে হতো।

সে সময় পাঁচ-ছ’টি আন্তর্জাতিক ট্যুর অপারেটর ছিল যারা চীন হয়ে উত্তর কোরিয়ায় গাইডেড ট্যুর করাতো।

কিন্তু ২০১৭ সালে এই ধরণের ভ্রমণের নিয়মকানুন কঠোর করা হয়। অনেকের মতে এর একটা কারণ ছিল, একজন পশ্চিমা ছাত্র এভাবে উত্তর কোরিয়ায় গিয়ে ইয়াংগাকো হোটেলের সেই নিষিদ্ধ পঞ্চম তলায় গিয়েছিলেন।

বেইজিং থাকার সময় কেলভিন সান দেখলেন, আমেরিকায় ফিরে যাবার আগে তার হাতে এক সপ্তাহ সময় আছে।

তিনি ভাবলেন, উত্তর কোরিয়ায় যাবার জন্য এটাই তো সুবর্ণ সুযোগ।

তিনি তখন ট্যুর অপারেটরদের সাথে যোগাযোগ করলেন এবং যে সবচেয়ে ভালো অফার দিলো তাকে বেছে নিলেন।

“আমি যত ভিসা ফর্ম পূরণ করেছি তার মধ্যে অন্যতম সহজ ছিল উত্তর কোরিয়ারটি। সেদেশে যাবার আবেদনের জন্য আপনাকে এমনকি পাসপোর্টটিও জমা দিতে হতো না। আমার ধারণা অনেক লোকই চেষ্টা করতেও চায় না কারণ তারা মনে করে ব্যাপারটা খুব ঝামেলার হবে।”

নিউইয়র্কে ফিরে যাবার আগে সে দফায় উত্তর কোরিয়াই ছিল শেষ দেশ। এর পরই তার মেডিক্যাল স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষের পড়াশোনায় ফিরে যাবার কথা।

সান ছিলেন ২০ জনের একটি গ্রুপের অংশ। এতে আমেরিকান, ইউরোপিয়ান এবং চীনা পর্যটকরা ছিলেন – যাদের অধিকাংশের বয়েসই ছিল ২০-এর কোঠায়।

বেইজিংএ তারা ট্যুর আয়োজকদের সাথে দেখা করলেন, তাদের বুঝিয়ে দেয়া হলো যে উত্তর কোরিয়া সফরের সময় কিভাবে চলতে হবে।

বলা হলো, উত্তর কোরিয়ার সংস্কৃতিকে সম্মান করতে হবে, সব সময় গাইডদের কথা শুনতে হবে।

রাজধানী পিয়ংইয়ংএ তারা থাকবেন ইয়াংগাকডো হোটেলে। তবে এর পাঁচতলার ব্যাপারে কোন কিছুই বলা হয় নি।

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

কেলভিন সান পিয়ং ইয়ং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

পিয়ংইয়ং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই সানের চোখে পড়লো যে জায়গাটা চীনের চেয়ে কত আলাদা।

“মনে হলো যেন ঈশ্বর নিজেই সব রঙকে অনুজ্জ্বল করে দিয়েছেন,”বলছিলেন সান

“বেইজিং ছিল এক রঙিন শহর। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার সাথে তুলনায় তাকে রীতিমত উৎকট মনে হবে।”

“শহরের ভবন, পোস্টার, রাস্তার নির্দেশিকা, লোকজনের কাপড়-চোপড় – সবই যেন শুধু সাদা, ধূসর বা কালো। তার মাঝে একটু হয়তো লাল আছে – কারণ তা কমিউনিস্ট পার্টির রঙ। মনে হচ্ছিল যেন আমি একটা টাইম মেশিনে বসে ১৯৭০এর দশকের সোভিয়েট টিভির অনুষ্ঠানে ঢুকে পড়েছি।”

সান এবং তার দলকে উত্তর কোরিয়া ঘুরে দেখানোর দায়িত্বে ছিলেন দুজন পুরুষ এবং একজন মহিলা গাইড। তাদের বয়েস ছিল ৪০-এর কোঠায়।

তারা জানালেন, দু’জনই এক সময় উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনীতে কর্মকর্তা ছিলেন।

“শুরুতে তাদের মনে হয়েছিল একটু কড়া ধরণের। তারা বলছিল, তাদের সাহায্য ছাড়া রাস্তার পার না হতে, বা কিছু-কিছু ভবনের ছবি না তুলতে। কিন্তু একটু পরই আমাদের সাথে তাদের বেশ ভাব হয়ে গেল।”

সান বলছিলেন,”গাইডরা মদ্যপান করতে ভালোবাসতেন। আমরা জানতে পারলাম যে কোরিয়ান সংস্কৃতিতে মদের একটা কেন্দ্রীয় ভুমিকা আছে, এবং তারা প্রতি সন্ধ্যাতেই তাদের সাথে আড্ডা-গল্পগুজব করতে আমাদেরকে উৎসাহিত করতেন।”

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

পিয়ংইয়ং

তারা উত্তর কোরিয়ার বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গা ঘুরলেন। যেমন জুচে টাওয়ার, ওয়াকার্স মেমোরিয়াল, দুই কোরিয়ার মধ্যেকার অসামরিকীকৃত অঞ্চল। আরো দেখলেন ইউএসএস পুয়েবলো – ১৯৬৮ সালে উত্তর কোরিয়ার জিম্মি করা মার্কিন নৌ-বাহিনীর জাহাজ।

তবে উত্তর কোরিয়া কী চোখে আমেরিকাকে দেখে সেটির আসল ধারণা সান পেয়েছিলেন সেই সব মদ্যপান এবং সামাজিক মেলামেশার সময়।

দেশটিতে ইন্টারনেট সরকার-নিয়ন্ত্রিত এবং সেখানকার টিভিও সীমিত এবং প্রধানত: সরকারি প্রচারণাই চালানো হয়।

“আমাদের গাইডরা মাইকেল জ্যাকসনের ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিল। তারা আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছিল, তিনি এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন কিনা। তারা যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের নির্মমতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন করেছিল। উত্তর কোরিয়ায় যে অল্প কিছু আন্তর্জাতিক টিভি অনুষ্ঠান দেখানো হতো তার একটি ছিল আমেরিকান রিয়ালিটি শো ‘কপস’ যাতে পুলিশ কর্মকর্তাদের অনুসরণ করে তার বাস্তব অভিযান দেখানো হয়। এটি নিয়েও তারা অনেক প্রশ্ন করতো।”

কিন্তু তাদের প্রশ্নের বিষয়বস্তু নয় – বরং যেভাবে তারা প্রশ্নগুলো করতো, সেটাই সানকে চমৎকৃত করতো।

“মনে হতো এটা নিতান্ত কৌতুহলের চাইতেও বেশি কিছু। যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের মনে যে বিশেষ ধারণা রয়েছে – সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছেন তারা।”

উত্তর কোরিয়ার একটি গ্রামে এক শুটিং রেঞ্জে সান তার জীবনের প্রথমবারের মতো বন্দুকের গুলি ছুঁড়লেন। গ্রুপের বেশির ভাগের গুলিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। “গাইডদের মনে আমেরিকার বন্দুক-সহিংসতা সম্পর্কে যে ধারণা ছিল – তাতে তারা আমাদের হাতের টিপ এত খারাপ দেখে উচ্চস্বরে তাদের বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।”

কয়েকদিন পার হবার পর নিয়মকানুন নিয়ে গাইডদের কড়াকড়ি কমে গেল।

এর পর গ্রুপের কেউ একা-একা রাস্তা পার হলে তারা আর উদ্বিগ্ন হতেন না। ছবি না তোলার জন্য নির্দেশও আর দিতেন না তারা।

সপ্তাহটি ছিল সত্যি মনে রাখার মতো। সানের সাথে খুব দ্রুতই অন্য সফরসঙ্গীদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল।

গাইডদের সাথেও সম্পর্ক সহজ হয়ে এলো তাদের। উত্তর কোরিয়ায় তাদের শেষ রাতে পুরো গ্রুপটি সবাই মিলে ডিপ্লো নামে একটা নাইটক্লাবে গেলেন।

সেখানে মাইকেল জ্যাকসন সহ ১৯৮০-র দশকের বিভিন্ন গানের সাথে তারা নাচলেন।

ইয়াংগাকডো হোটেলে ফিরে গাইডরা আরো একদফা মদ্যপানের জন্য গ্রুপটিকে আমন্ত্রণ জানালেন। তারা বেশি সময় ছিলেন না। তারা একটা ব্যস্ত সপ্তাহ কাটিয়েছেন।

এর পর গ্রুপটির সদস্যরা যে যার রুমের দিকে রওনা দিলেন। কিন্তু কয়েকজন, যারা অতটা ক্লান্ত হননি, তারা ভাবলেন ঘুমোতে যাবার আগে একটা ঘরে সবাই মিলে আবার একটা আড্ডা হোক।

তখনই আরেকজন প্রস্তাব করলেন, হোটেলটার বাকি অংশগুলো ঘুরে দেখলে কেমন হয়?

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

কেলভিন সান হোটেলের পাঁচতলার সন্ধানে কেলভিন সানদের অভিযান

উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে উঁচু ভবনগুলোর একটি হচ্ছে ৪৭-তলা এই ইয়াংগাকডো হোটেল। তায়েডং নদীর মাঝখানে একটি দ্বীপের ওপর গড়ে তোলা হয়েছে এই হোটেল।

এতে আছে চারটি রেস্তোরাঁ, বোলিং এবং ম্যাসাজ পার্লার। বেডরুমগুলোতে টিভি আছে তাতে পুরোনো বিবিসির ওয়ার্ল্ড নিউজ বার বার দেখানো হয়।

এ দেশে আসা টুরিস্টদের কাছে এটাই সবচেয়ে পছন্দের থাকার জায়গা।

উত্তর কোরিয়ার টুরিস্ট বোর্ড একে পাঁচতারা হোটেল হিসেবে প্রচার করে কিন্তু ইন্টারনেটে পর্যটকদের মূল্যায়নে একে তিন-তারার কাছাকাছি বলে উল্লেখ করা হয়।

“দেখে মনে হতে পারে যেন তারা ১৯৮৪ সালে ভেগাসে কাউকে পাঠিয়েছিল, বলা হয়েছিল, ওখানে গিয়ে দেখে এসো কী কী আছে, তার পর হুবহু সেরকম একটা হোটেল বানিয়ে ফেলো। তারা সেটাই করেছে, কিন্তু তা করতে গিয়ে গোলমাল করে ফেলেছে,” এমন বর্ণনাই করেছেন একজন ব্লগার।

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

কেলভিন সান কেলভিন সান বলেন, তারা যা করছিলেন তা কত গুরুতর তা বোঝেন নি তারা

এই হোটেলে পাঁচ রাত থাকার সময় সান এবং তার সফরসঙ্গীদের সাথে সর্বক্ষণ ছিল গাইডরা।

তাদের ছাড়া নিজেরা নিজেরা ভবনটি ঘুরে দেখার এটাই সুযোগ। তাছাড়া এমন কোন নিয়মের কথা তো বলা হয়নি যে হোটেলটা ঘুরে দেখা যাবে না।

তারা প্রথমে উঠলেন খোলা ছাদে। তারপর গেলেন একেবারে ওপরের তলায় ঘুর্ণায়মান রেস্তোরাঁতে। তার পর লিফট দিয়ে নিচে নামতে লাগলেন।

তখনই গ্রুপের একজন খেয়াল করলেন যে লিফটে পাঁচ তলায় যাবার কোন বোতাম নেই। লিফটের প্যানেলে দেখা যাচ্ছে চারতলা, তার পরই পাঁচ বাদ দিয়ে ছয় তলা।

“আমাদের দেখা উচিত এর কোন পাঁচ তলা আসলেই আছে কিনা। নাকি তারা কোন কুসংস্কারের কারণে ইচ্ছা করেই লিফটে পাঁচতলা বলে কিছু রাখেনি,”একজন বললেন।

ভ্রমণ বিষয়ক ব্লগাররা এই হোটেলের গোপন পাঁচতলায় কি আছে তা নিয়ে ইন্টারনেটে অনেক জল্পনা কল্পনা করেছেন।

সানের গ্রুপে কয়েকজন ছিলেন যারা অভিজ্ঞ পর্যটক, তারা এটার কথা শুনেছিলেন। সান এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।

“ইয়াংগাকডো হোটেলের পাঁচ তলায় গেছি এমন প্রথম লোক আমরা ছিলাম না, শেষও ছিলাম না। ২০১১ সাল পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ায় কোন পর্যটককে কখনো আটক করা হয় নি। আমরা যা করছিলাম তা কতটা গুরুতর তার কোন ধারণা আমাদের ছিল না।”

সানরা যে ট্যুর অপারেটরকে ভাড়া করেছিলেন, সেই ইয়ং পাইওনিয়ার ট্যুরসের ওয়েবসাইটে এখন একটি পাতা আছে যাতে বলা আছে যে পর্যটকদের জন্য পাঁচ তলায় যাওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

এরকম কোন সতর্কবাণী ২০১১ সালে অনলাইনে বা অফলাইনে কোথাও ছিল না।

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

কেলভিন সান রহস্যময় পাঁচতলায় কেলভিন সানের দল

“আমাদের কখনোই পঞ্চম তলা থেকে দূরে থাকতে বলেনি আমাদের গাইডরা। এ নিয়ে কোন কথাই হয়নি।”

অন্য একজন পর্যটক যিনি এর আগেও সেখানে গেছেন, তিনি জানিয়েছিলেন যে পঞ্চম তলার যেহেতু টেকনিক্যালি কোনো অস্তিত্ব নেই, তাই সেখানে গেলে তাদের কোনো অসুবিধে হবেনা।

ফলে সান-রা চারতলায় পৌঁছে লিফট থেকে বেরিয়ে এলন, এবং হোটেলের পেছনের অংশের সিঁড়ির দিকে গেলেন। তারা হাসিখুশিই ছিলেন, তবে সান বলেন যে তাদের ভেতরে একটা উত্তেজনাও কাজ করছিল।

“আমাদের একজন করিডোরে আমাদের আগে আগে হাঁটছিল। সে হঠাৎ ঘুরে দৌড়ে এলো। বললো, ‘না, এদিকে নয়, আমি একটা চিৎকার শুনতে পেয়েছি।’

সান বলেন, তিনি কোন চিৎকার শুনতে পাননি, কিন্তু তার ভয়-ভয় লাগছিল।

“আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে দিক পরিবর্তন করে আমরা ছয় তলায় যাবো, তার পর সিঁড়ি দিয়ে পাঁচ তলায় নামবো।”

এই পথ দিয়ে পাঁচ তলায় ঢুকতে গিয়ে তারা দেখলেন সেখানে কোন পাহারা নেই, এবং পথটা খোলা। তারা যার যার ক্যামেরা বের করলেন, এবং ভেতরে ঢুকলেন।

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

কেলভিন সান ঘরগুলোর ছাদ খুব নিচু

প্রথম যেটা তাদের চোখে পড়লো যে সেই ফ্লোরের ছাদ খুব নিচু, অন্য তলাগুলোর তুলনায় প্রায় অর্ধেক। তাদের কয়েকজনকে মাথা কাত করে বা নিচু করে চলতে হচ্ছিল। তারা একেকজন গেলেন একেক দিকে।

হাঁটতে হাঁটতে সান লক্ষ্য করলেন যে পুরো জায়গাটায় আলো খুব কম, কংক্রিটের বাংকারের মতো। নিচু সিলিং ছাড়া বাকিটা দেখতে একটা সাধারণ হোটেলের করিডোরের মতোই, দুপাশে দরজা।

বেশিরভাগ দরজাই বন্ধ, তবে একটি কক্ষ খোলা। দরজার বাইরে একজোড়া জুতো পড়ে আছে। কিন্তু ভেতরে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলেন না তারা।

“ঘরটার ভেতর থেকে আলো আসছিল। আমরা সিকিউরিটি ক্যামেরা দেখতে পেলাম। কিছু টিভি পর্দা আছে, তাতে বিভিন্ন বেডরুমের ভেতরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, এমন কিছু যন্ত্রপাতি দেখা যাচ্ছে যা নজরদারির জন্য ব্যবহৃত হয় বলে মনে হলো। আমি ভাবলাম, হোটেলের কর্মীরা অতিথিদের ওপর নজরদারি করার যে কথা শোনা গেছে তার যন্ত্রপাতি এখানেই রাখা হয়।”

সানের একজন বন্ধু জায়গাটির একটা ভিডিও করতে শুরু করলেন ।সান ছবি তুলতে লাগলেন। সবাই কথা বলছিলেন ফিস ফিস করে।

আমরা দুর্ঘটনাবশত: ফ্ল্যাশ ফটোগ্রাফিও ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু আমাদের খুঁজে বের করতে কেউ আসেনি।

ঘরগুলোর দেয়ালে উজ্জ্বল রঙে আঁকা আমেরিকা ও জাপান-বিরোধী প্রচারণামূলক ছবি ঝোলানো ছিল। এর কোনো কোনোটিতে ছিল সাবেক শীর্ষ নেতা কিম জং ইলের ছবি।

একটি ছবির ক্যাপশনে বলা হয়েছে: “এই বোমা আমেরিকানদের তৈরি। আমেরিকানদের তৈরি যে কোন জিনিসই আমাদের শত্রু। আমেরিকার বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ বার প্রতিশোধ নাও।”

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

কেলভিন সান আমেরিকান সবকিছুই আমাদের শত্রু’

কয়েক মিনিট পরে একজন অপরিচিত লোক ছায়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এগিয়ে এলো তাদের দিকে।

“পথ হারিয়েছো?” সে শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো ইংরেজিতে।

কেউ একজন বললো, হ্যাঁ। লোকটি মাথা নাড়লো, আঙুল দেখালো সিঁড়ির দিকে।

“সে আমাদের সাথে আমাদের রুম পর্যন্ত আসেনি, তাকে ক্রুদ্ধ বা উত্তেজিতও মনে হয় নি।”

গ্রুপটি একটি বেডরুমে ফিরে এলেন, তারা একমত হলের যে ওই হোটেলে কর্মকর্তার সাথে দেখা হওয়াতে তারা হুমকি অনুভব করেননি। কয়েকজন বললো তারা আবার যাবে সেখানে।

পাঁচতলায় গিয়ে ওই গ্রুপের একজন একটা দরজা খুললো। কিন্তু খোলার পর দেখা গেল একটা ইটের দেয়াল ছাড়া কিছুই নেই। আরেকজন আরেকটি দরজা খুলে দেখতে পেলো, সেখান থেকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে আরেক তলায়।

“বলতে পারেন, একটা ফ্লোরের ভেতরই আরেকটা ফ্লোর।”

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

কেলভিন সান জাপানবিরোধী পোস্টার

তারা আরো তালাবন্ধ কক্ষ এবং দেয়ালে লাগানো আরো পোস্টার দেখতে পেলেন। সানের কোরিয়ান ভাষা জানা ছিল না। কিন্তু ইউটিউবে তার ভিডিও তোলার পর তিনি এর কিছু বার্তার অর্থ জানতে পারলেন।

এসব পোস্টারে কিম পরিবারের শক্তি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রতিশোধ নেবার কথা আছে।

একবিংশ শতাব্দীকে প্রযুক্তির যুগ বলে ঘোষণা করা হয়েছে আরেকটি পোস্টারে, তাতে দেখা যাচ্ছে ১৯৮০র দশকের একটি কম্পিউটারের ছবি।

একটু পর আরেক জন হোটেল কর্মকর্তা সেখানে আবির্ভূত হলেন, এবং ভদ্রভাবে বললেন তাদের যার যার ঘরে ফিরে যেতে।

কিন্তু এরপরও কয়েকজন তৃতীয় বারের মতো ওই পাঁচতলায় গেলেন। এর মধ্যে দু’জন আলাদা হয়ে একটু আড়ালে গিয়ে চুমু খেলেন (এই তথ্য বের হয়েছিল অনেক বছর পর এক পুনর্মিলনীতে)।

এবার আরেকজন রক্ষী সেখানে এলেন, এবং আবারও শান্তভাবে তাদের ঘরে ফিরে যেতে বললেন।

“আমাদের সবারই বয়েস ছিল ২০-এর কোঠায়। আমার বোকা এবং সরল ছিলাম। আমাদের কাছে ব্যাপারটা নির্দোষ এবং উত্তেজনাপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তার পরের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, আমরা এখন যা জানি তা তখন জানলে এটা করতাম না।”

সান এবং তার সঙ্গীরা ভোর পাঁচটার দিকে যার যার ঘরে গেলেন। জিনিসপত্র ব্যাগে ভরে ফ্লাইটের জন্য তৈরি হলেন। তাদের মিনিবাস আসার কথা ঠিক দু’ঘন্টা পরই।

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

কলভিন সান পোস্টার: আমাদের জেনারেলই সবার সেরা

কিন্তু সকাল সাতটায় মিনিবাসে ওঠার পরই যখন হোটেল কর্মকর্তারা এসে তাদের বাস থেকে নামতে বললেন, তখন পুরো গ্রুপটির মধ্যেই উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়লো।

গাইডরা বললো, তারা জানে যে গ্রুপের একজন সদস্য কি করেছে, এবং এখনই তাদের তা স্বীকার করতে হবে। গ্রুপের কেউ কোন কথা বললো না।

একজন কর্মকর্তা বললো. ইয়াংগাকডো হোটেলের প্রাইভেট কক্ষ থেকে এমব্রয়ডারি করা তোয়ালে কেউ অনুমতি ছাড়া নিয়ে গেছে। গ্রুপটি যদি বাড়ি ফিরতে চায় তাহলে তোয়ালেগুলো ফেরত দিতে হবে।

কেউ দোষ স্বীকার করলো না।

টুর গাইডরা কর্মকর্তাদের সাথে একটা চুক্তি করলো। তারা যদি পেছন ফিরে বাস থেকে নেমে যায়, তাহলে অপরাধী তোয়ালেগুলো মাটির ওপর রেখে দেবে। এটাই হবে সমস্যা সমাধানের সবচাইতে দ্রুত পদ্ধতি।

রক্ষীরা মেনে নিলো।

চুরি করা তোয়ালে ফেরত পাওয়া গেল, কিন্তু চোর চিহ্নিত হলো না।

গ্রুপটি এরপর এয়ারপোর্টে গেল। উত্তর কোরিয়ান ভিসা ফেরত দিল। তাদের পাসপোর্টে সিল ছাড়াই তারা উত্তর কোরিয়া ত্যাগ করলো।

সান এর পরের বছর মেডিক্যাল স্কুলে তার দ্বিতীয় বছরের পড়াশোনা শুরু করলেন। পাঁচ তলার কথা তার প্রায় মনেই ছিল না।

কিন্তু চার বছর পরের এক ঘটনা সব বদলে দিলো।

—————

দু হাজার পনেরো সালে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ওটো ভার্মবিয়ের উত্তর কোরিয়া বেড়াতে যান কেলভিন সানের মত ঠিক একই কর্মসূচি নিয়ে। তার টুর অপারেটরও ছিল সেই একই ইয়ং পাইয়োনিয়র টুরস, তিনি ছিলেনও সেই একই ইয়াংগাকডো হোটেলে।

উত্তর কোরিয়ান কর্মকর্তারা বলেন, ভার্মবিয়ের ওই হোটেল থেকে একটি উত্তর কোরিয়ান পোস্টার চুরি করার চেষ্টা করেছিলেন।

এর পর তার একটা সাজানো বিচার হয়, টিভিতে প্রচার হয় একটা জোর করে ধারণ করা স্বীকারোক্তি।

বন্দী অবস্থায় তিনি আহত হন, এবং সংজ্ঞা হারান। আর কখনো তার জ্ঞান ফেরে নি।

২০১৭ সালের জুন মাসে ওটো ভার্মবিয়েরের মৃত্যু আন্তর্জাতিক সংবাদের শিরোনাম হয়।

সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজে আভাস পাওয়া যায় যে ভার্মবিয়ের ওই হোটেলের এমন একটি অংশে গিয়েছিলেন – যা সাধারণ লোকের জন্য উন্মুক্ত নয়।

উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র

ওটো ভার্মবিয়ের, আটক হবার পর

ওই হোটেলে আগে গেছেন এমন কয়েকজন বলেছেন, তিনি নিশ্চয়ই সেই পাঁচ তলায় গিয়েছিলেন এবং দেয়াল থেকে কোন একটি প্রচারণামূলক পোস্টার সরিয়েছিলেন।

কিন্তু উত্তর কোরিয়ার সরকার বা হোটেলে কর্তৃপক্ষ কখনোই তা নিশ্চিত করেনি, যেভাবে তারা কখনো পঞ্চম তলার অস্তিত্বের কথাও স্বীকার করে নি।

সান বলছেন, “আমরা যখন সেখানে ছিলাম তখন সেখোনে এমন কোন পোস্টার ছিল না যা খুলে নেয়া যাবে। সবই ছিল দেয়ালে আঁকা বা দেয়ালের সাথে পেরেক দিয়ে আটকানো। এমন নয় যে আমরা কিছু নেবার কথা ভেবেছি, কিন্তু সেখানে এমন কিছুই ছিল না যা আমাদের পক্ষে চুরি করা সম্ভব ছিল, ঘরের বাইরের জুতো দুটি ছাড়া।”

ভার্মবিয়েরের মৃত্যুর পর উত্তর কোরিয়ায় পর্যটনের দিকে সবার নজর পড়ে।

ইয়ং পাইওনিয়র ট্যুরস সহ বেশ কিছু ট্যুর অপারেটর মার্কিন নাগরিকদের উত্তর কোরিয়ায় নিয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। তাদের ওয়েবসাইটে বলা হয়, ওই হোটেলের পাঁচতলাটি একটি সার্ভিস ফ্লোর যাতে কারো প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

সান এখন একজন ডাক্তার। তিনি সুযোগ পেলেই এখনো ভ্রমণ করেন। তার ব্লগে হাজার হাজার ফলোয়ার রয়েছে। তবে এখন তিনি অন্য দেশে বেড়াতে গিয়ে কি করছেন সে সম্পর্কে অনেক বেশি সতর্ক।

“ওটোর যা হয়েছে, তা আমার কাছে একটা মর্মান্তিক ব্যাপার। এখন আমরা যতটুকু জানি, তার ভিত্তিতে আমি সব পর্যটককে বলবো তা যখন যে দেশে যায় সেই দেশের রীতিনীতিকে যেন সম্মান করে।”

“তবে ২০১১ সালে আমাদের জানা ছিল না যে আমরা কোন বাড়াবাড়ি করছি কিনা বা আমরা যা করছি তাতে ওটোর মতো দু:খজনক পরিণতিও হতে পারতো।”

(অন্য কোন কিছু উল্লেখ না করা থাকলে এই প্রতিবেদনের সব ছবির স্বত্বই কেলভিন সান এবং দি মনসুন ডায়রিজের।)

 

সূত্র, বিবিসি

Facebook Comments Box


এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



Exchange Rate

Exchange Rate EUR: Thu, 21 Nov.

সর্বশেষ খবর



Agrodristi Media Group

Advertising,Publishing & Distribution Co.

Editor in chief & Agrodristi Media Group’s Director. AH Jubed
Legal adviser. Advocate Musharrof Hussain Setu (Supreme Court,Dhaka)
Editor in chief Health Affairs Dr. Farhana Mobin (Square Hospital, Dhaka)
Social Welfare Editor: Rukshana Islam (Runa)

Head Office

UN Commercial Complex. 1st Floor
Office No.13, Hawally. KUWAIT
Phone. 00965 65535272
Email. agrodristi@gmail.com / agrodristitv@gmail.com

Bangladesh Office

Director. Rumi Begum
Adviser. Advocate Koyes Ahmed
Desk Editor (Dhaka) Saiyedul Islam
44, Probal Housing (4th floor), Ring Road, Mohammadpur,
Dhaka-1207. Bangladesh
Contact: +8801733966556 /+8801316861577

Email Address

agrodristi@gmail.com, agrodristitv@gmail.com

Licence No.

MC- 00158/07      MC- 00032/13

Design & Devaloped BY Popular-IT.Com
error: দুঃখিত! অনুলিপি অনুমোদিত নয়।